বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা : ফের আইপিএস অফিসার নিয়ে দিল্লির সঙ্গে সঙ্ঘাতে পশ্চিমবাংলার সরকার। রাজ্যের তিনি আইপিএস অফিসারকে কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনে কাজ করতে তলব করেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। এ ব্যাপারে পশ্চিমবাংলার সরকারকে চিঠিও দিয়েছে তারা। তিন আইপিএস অফিসার হলেন দক্ষিণবঙ্গের এডিজি রাজীব মিশ্র, প্রেসিডেন্সি রেঞ্জের ডিআইজি প্রবীণ ত্রিপাঠি এবং ডায়মন্ড হারবারের পুলিশ সুপার ভোলানাথ পাণ্ডে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার শিরাকোলে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি (জগৎপ্রকাশ) নাড্ডার কনভয়ে হামলার পর এই ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবারে দলীয় কর্মিসভায় যাওয়ার পথে জে পি নাড্ডার কনভয়ে হামলার ঘটনা আটকাতে পুলিশের ভূমিকায় যথেষ্ট খামতি ছিল। এ ক্ষেত্রে এই তিন অফিসার তাঁদের দায় এড়াতে পারেন না বলে ধারণা কেন্দ্রীয় সরকারের। তাঁদের ডেপুটেশনে নিতে চাওয়ার পেছনে ওই ঘটনা থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
কিন্তু শনিবার রাতের খবর, রাজ্য সরকার সেই অফিসারদের ছাড়তে নারাজ। তারা তাঁদের ‘নো অবজেকশন’ দিতে চাইছে না। যদিও নবান্নের তরফে কেন্দ্রকে জানানো হয়েছে, রাজ্যের হাতে নাকি বেশি আইপিএস অফিসার নেই। তাই তাঁদের কেন্দ্রের ডেপুটেশনে পাঠানো সম্ভব নয়। কিন্তু শেষ অবধি কি আইপিএস অফিসারদের রাজ্য সরকার আটকে রাখতে পারবে? এই প্রশ্ন এখন ঘুরছে রাজ্যের প্রশাসনিক মহলে। এ কথা ঠিক, অফিসারদের ইচ্ছে থাকুক, চাই না থাকুক, কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের ডেপুটেশনে রাজ্যের কাছ থেকে চাইতেই পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের কাছ থেকে ‘আপত্তি নেই’ শীর্ষক ছাড়পত্র পেতে হয়। সেই ছাড়পত্র না পেলে কোনও অফিসারকে রাজ্যের কাছ থেকে কেন্দ্র তুলে নিতে পারে না। তাই রাজ্য সরকার না চাইলে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের দিল্লি নিয়ে যেতে পারবে না। কিন্তু রাজ্য কি শেষ অবধি আটকে রাখতে পারবে কোনও অফিসারকে? কেন না, আইপিএস ক্যাটেগরির অফিসাররা কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন। ১৯৫৪ সালের আইপিএস সার্ভিস (ক্যাডার) আইন অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মধ্যে কোনও রকম মতভেদ হলে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকে। তাই শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের নির্দেশ মানতে বাধ্য রাজ্য সরকার।
এখন প্রশ্ন হল, এই তিন অফিসারকে রাজ্য সরকার কেন কেন্দ্রকে দিতে চাইছে না? তা হলে কি সত্যিই তাঁরা শাসক দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে কাজ করছেন? প্রসঙ্গত, কিছুদিন আগে বাংলার রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে চিঠি দিয়ে ২১ জন আইপিএসের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তাঁরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কাজ করছেন বলে ছিল রাজ্যপালের অভিযোগ। যদিও ওই তালিকায় এই তিন অফিসার রয়েছেন কিনা, সে ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি। তবে জে পি নাড্ডার কনভয়ে হামলার ঘটনায় তাঁদের দায় যে রয়েছে, এমনই মনে করছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আধিকারিকরা। ওই অফিসারদের দিল্লি তুলে নিয়ে যাওয়ার কেন্দ্রীয় প্রয়াসের পিছনে সেই কারণ থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই ওই অফিসাররা যে এখন তীব্র মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে গিয়েছেন, সে কথা বলাই বাহুল্য। কেন না, এই অফিসারদের নিয়ে রাজ্য সরকার শেষ পর্যন্ত কতখানি সঙ্ঘাতে যায়, সেটাই এখন দেখার। এর আগে রাজীব কুমারকে নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাতে গিয়েছিল রাজ্য।
সারদা কেলেঙ্কারি মামলায় কলকাতার সেই সময়ের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বাড়িতে তল্লাশি চালায় সিবিআই। তখন প্রতিবাদে কলকাতার ধর্মতলায় ধর্নায় বসেছিলেন মমতা। তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকজন আইপিএস অফিসার যোগ দিয়েছিলেন। ওই ঘটনা নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত রাজীব কুমারকে সিবিআই গ্রেফতার করেনি। তবে বেশ কিছুদিন পালিয়ে থাকতে হয়েছিল রাজীব কুমারকে। পরে অবশ্য বিষয়টি থিতিয়ে যায়। বিষয়টি এখন দেশের শীর্ষ আদালতে বিচারাধীন। তবে সেই সময় রাজ্য সরকারের কাছ থেকে রাজীব কুমারকে ডেপুটেশনে চায়নি কেন্দ্র। তাই এই তিন অফিসারকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী হয়, সে দিকে তাকিয়ে রয়েছে তথ্যাভিজ্ঞ মহল।
সূত্রের খবর, দক্ষিণবঙ্গের এডিজি রাজীব মিশ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি শাসক দল তথা মুখ্যমন্ত্রীর অত্যন্ত ‘স্নেহভাজন’। বিজেপির অমিত মালব্য একটি ভিডিও টুইট করেছেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, পূর্ব মেদিনীপুরের প্রশাসনিক বৈঠকের পর তাঁকে কেক খাইয়ে দিচ্ছেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর উর্দি পরে থাকা অবস্থাতেই রাজীব মিশ্র মুখ্যমন্ত্রীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছেন। ডায়মন্ড হারবারের পুলিশ সুপার ভোলানাথ পাণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নাকি মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো তথা ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অত্যন্ত আস্থাভাজন। প্রেসিডেন্সি রেঞ্জের ডিআইজি প্রবীণ ত্রিপাঠির সঙ্গেও তৃণমূলের শীর্ষনেতাদের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তুলেছে বিজেপি।
রাজ্যের পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলির অভিযোগ নতুন নয়। বিজেপির মুকুল রায়ের অভিযোগ, বাংলায় এখন পুলিশরাজ চলছে। অন্যদিকে, কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নানের বক্তব্য, জেলার পুলিশ সুপাররা তৃণমূলের জেলা সভাপতির মতো আচরণ করেন। রাজ্যের বর্তমান পুলিশ অফিসারদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বাম দলগুলিও।